আবারও সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে ঢুকেছেন রোহিঙ্গারা। নাফ নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে এসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নাফ নদী অতিক্রম করে টেকনাফে ঢুকছেন তারা।
জানা গেছে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘর্ষ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন রাখাইন রাজ্যে বেড়েছে সহিংসতা। মাঝে মাঝে বোমা ও বিমান হামলার কারণে কেঁপে উঠছে সীমান্ত এলাকা ও টেকনাফের আশপাশ।
টেকনাফের সীমান্তের বাসিন্দারা বলেন, ওপারে মর্টার শেল ও শক্তিশালী গ্রেনেড-বোমার বিস্ফোরণে এপারের ঘরবাড়ি কাঁপছে। বিস্ফোরণের শব্দ শুনে মনে হয় বসতঘরের চালার ওপর বোমা এসে পড়ছে। রাতে বিকট শব্দে বিস্ফোরণে ঘুম ভেঙে শিশুরা কান্নাকাটি শুরু করে।
রোহিঙ্গা সূত্র বলছে, সীমান্তে অন্তত ৩০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য অপেক্ষা করছে। যে কোনো সময় এসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে পারে। উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, বিজিবি ও কোস্টগার্ডের চোখ ফাঁকি দিয়ে এরই মধ্যে অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। বাংলাদেশে ঢোকার জন্য রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন পয়েন্টে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা জড়ো হয়েছে বলে আমরা শুনতে পাচ্ছি।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা বলেন, আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে আট হাজারের মতো রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। তাদের অধিকাংশই গত ২ মাসে এসেছেন। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বাড়তি বোঝা বহন করছে, আর কোনো রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই।
অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মোহাম্মদ তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, এই সংকট নিয়ে কথা বলতে আগামী দু-তিন দিনের মধ্যে উপদেষ্টাদের সভায় আলোচনা করা হবে। রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতি জানালেও সরকারের নতুন করে আরও শরণার্থীকে মানবিক আশ্রয় দেওয়ার সামর্থ্য নেই বলে জানিয়েছেন মোহাম্মদ তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, সীমান্ত পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব নয়, তবে এরকম অনুপ্রবেশ রুখতে বাড়তি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে রোহিঙ্গা। শনিবার (৭ সেপ্টেম্বর) ও এর আগের দিন শুক্রবার (৬ সেপ্টেম্বর) দুই দিনেই ৭০০-৮০০ রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এপারের দালালরা মোটা অঙ্কের বিনিময়ে সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা নিয়ে আসছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
অনেকটা গোপনে এবং বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে কিছু কিছু রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশের কথা স্বীকার করেছেন রোহিঙ্গা ক্যাম্প ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত সরকারের যুগ্ম সচিব ও কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) অফিসের অতিরিক্ত আরআরআরসি মো. শামছুদ্দৌজা নয়ন।
রবিবার (৮ সেপ্টেম্বর) সকালে তিনি বলেন, ‘আগস্টের আন্দোলনের সময়টার সুযোগ নিয়ে অন্তত ৮ হাজার রোহিঙ্গা ঢুকে পড়েছে ক্যাম্পগুলোতে। এসব অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা কে কোন ক্যাম্পে রয়েছে, তার তালিকাও ইতিমধ্যে করা হয়েছে। তবে পরবর্তী সময়ে এ রকম বড় চালানের রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেনি।
এ ছাড়া মিয়ানমারের মংডুর মনিপাড়া, সিকদারপাড়া ও আইরপাড়া এলাকায় হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক রোহিঙ্গা নেতা বলেন, নতুন করে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েই এপারের দালালরা রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ করাচ্ছে।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা এমনও জানান, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘাতের মধ্যে সীমান্তে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা বাংলাদেশে ঢুকে উখিয়া-টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছেন।
শনিবার মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে ক্যাম্প-১-এর বি-ব্লকে আশ্রয় নিয়েছেন সাব্বির আহমেদ। তিনি জানান, তার দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে টেকনাফের জাদিমুড়া সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন।
সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিরা জানান, রাখাইনের মংডু টাউনশিপের বিপরীতে (পশ্চিমে) চার কিলোমিটার প্রস্থের নাফ নদ পেরোলেই বাংলাদেশের টেকনাফ উপজেলা। রাতের অন্ধকারে মংডু টাউনশিপের সুদাপাড়া, ফয়েজীপাড়া, সিকদারপাড়া ও নুরুল্লাপাড়া গ্রাম থেকে রোহিঙ্গারা নৌকা নিয়ে নাফ নদ অতিক্রম করে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে। বেশির ভাগ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকছে জাদিমোরা, দমদমিয়া, কেরুনতলি, বরইতলি, নাইট্যংপাড়া, জালিয়াপাড়া, নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, নয়াপাড়া, শাহপরীর দ্বীপ, জালিয়াপাড়া, মিস্ত্রিপাড়া, ঘোলারচর, খুরেরমুখ, আলীর ডেইল, মহেষখালীয়াপাড়া, লম্বরী, তুলাতলি, রাজারছড়া, বাহারছড়া সীমান্ত এবং উপকূল দিয়ে।
টেকনাফে আশ্রয়শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সহকারী পুলিশ সুপার মাইন উদ্দিন বলেন, ‘কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে ঢুকে পড়েছে। তাদের নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। নতুন করে কোনো রোহিঙ্গা যেন ঢুকতে না পারে, সে ব্যাপারে আশ্রয়শিবিরে কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আদনান চৌধুরী বলেন, ‘সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে। অনুপ্রবেশের সময় বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে নাফ নদ থেকে পুনরায় মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাফ নদ ও সীমান্তে টহল জোরদার করা হয়েছে।